ঋতুস্রাবের অনিয়মিততা :

বর্তমান সময়ে মেয়েদের শারীরিক সমস্যার মধ্যে অন্যতম প্রধান সমস্যা হয়ে দাড়িয়েছে ঋতুস্রাবের অনিয়মিততা। অনেকেই কমবেশি এ সমস্যার সম্মুখীন হয়ে থাকেন। আসুন জেনেনিই এর কিছু কারণ এবং তার প্রতিকার। বেশ কয়েক রকমের ঋতুস্রাবের অনিয়মিততা হয়, অল্প সময়ের সাধারণ ঋতুস্রাবের সমস্যা থেকে শুরু করে আরও দীর্ঘ সময়ের ঋতুস্রাবের সমস্যার জন্য গুরুতর অসুস্থতা। নীচের ঋতুস্রাবের অনিয়মিততার তালিকাটি আপনাকে বিভিন্ন ঋতুস্রাব চক্রে অনিয়মিততার মাত্রা চিহ্নিত করতে সাহায্য করবে।


ডিসমেনোরিয়া
ডিসমেনোরিয়া হচ্ছে যন্ত্রণাদায়ক স্রাবকালীন খেঁচুনি। দুই রকমের ডিসমেনোরিয়া আছে, প্রাথমিক ডিসমেনোরিয়া এবং পরবর্তী ডিসমেনোরিয়া। প্রাথমিক ডিসমেনোরিয়া হচ্ছে স্রাবের সময়ে যন্ত্রণা।
প্রাথমিক ডিসমেনোরিয়া হচ্ছে ঋতুস্রাব হওয়া মহিলাদের জন্য সবচাইতে প্রচলিত স্ত্রীরোগজনিত সমস্যা। এটার সংজ্ঞা হচ্ছে, পেলভিক রোগ না থাকা সত্বেও স্রাব শুরু হওয়ার সাথে সাথে তলপেটে খেঁচুনিকর যন্ত্রণা। এটাকে পরবর্তী ডিসমেনোরিয়া থেকে আলাদা করে বিবেচনা করতে হবে যা পেলভিক প্যাথলজি থেকে হওয়া, যেমন এন্ডোমেট্রিওসিস, যন্ত্রণাদায়ক স্রাবকে বোঝায়।
এটা হওয়ার মাত্রা ৯০% পর্যন্ত। বেশী মাত্রায় ডিসমেনোরিয়ার সাথে গুরুতর ঝুঁকি জড়িত: অল্প বয়সে প্রথম ঋতুস্রাব, অনেকদিন ধরে স্রাব, ধূমপান, স্থূলতা এবং মদ্যপান। ওজন কমানোর চেষ্টাও বেশী যন্ত্রণাদায়ক স্রাবের সাথে জড়িত মনে করা হয়। শারীরিক পরিশ্রম যন্ত্রণার সাথে জড়িত নয়। সন্তান ধারণের পরে স্রাবকালীন যন্ত্রণা কমে যায় বলে ধারণার পেছনে কোন গবেষণা নেই।
পরবর্তী ডিসমেনোরিয়া হচ্ছে এমন যন্ত্রণা যা অতিরিক্ত প্রোস্টাগ্ল্যান্ডিনস্, জরায়ুর অতিরিক্ত সংকোচন বা অন্য কোন রোগ থেকে হয়।

এ্যামেনোরিয়া
ঋতুস্রাব না হওয়াকে এ্যামেনোরিয়া বলে। এ্যামেনোরিয়া দুই রকমের হয়, প্রাথমিক এ্যামেনোরিয়া এবং পরবর্তী এ্যামেনোরিয়া। প্রাথমিক এ্যামেনোরিয়া হচ্ছে এমন একটা অবস্থা যখন একজন মহিলার কখনোই রজঃস্রাব হয় নি। পরবর্তী এ্যামেনোরিয়া হচ্ছে এমন অবস্থা যখন অন্ততঃ ছয় মাস কোন ঋতুস্রাব হয় নি। পরবর্তী এ্যামেনোরিয়া সাধারণতঃ গর্ভাবস্থার জন্য হয়। .

মেনোরেজিয়া
মেনোরেজিয়া হচ্ছে অতিরিক্ত রজঃস্রাব হওয়া। মেনোরেজিয়াকে হাইপারমেনোরিয়া-ও বলা হয়। স্বাভাবিকের থেকে বেশী রজঃস্রাবকে মেনোরেজিয়া বোঝায় না। খুব বেশী রক্তপাত বা সাত দিনের বেশী রক্তপাত হতে থাকলে তাকে বোঝায়। মেনোরেজিয়ার সাথে বড় জমা রক্ত সহ রজঃস্রাবও হতে পারে। হরমোনের অসাম্যতা বা গর্ভাশয়-সম্বন্ধীয় ফাইব্রয়েড এর কারণে প্রায়শঃই এটা হয়।

এন্ডোমেট্রিয়ালক্যান্সার
জরায়ুর ঝিল্লীতে ক্যান্‌সারকে এন্ডোমেট্রিয়াল ক্যান্‌সার বলে। সাধারণতঃ এন্ডোমেট্রিয়াল ক্যান্‌সারে যোনিনালী দিয়ে অস্বাভাবিক রক্তপাত হয়। এটা একটা গুরুতর অসুস্থতা, কিন্তু তাড়াতাড়ি ধরা পড়লে সফলভাবে চিকিত্‌সা সম্ভব। এটা ৫০ বছর বয়সের উপরের মহিলাদের মধ্যে প্রচলিত অথবা যেসব মহিলার এস্ট্রোজেনের মাত্রা অধিক।

ফাইব্রয়েডস্
ফাইব্রয়েডস্ হচ্ছে জরায়ুর মাংসপেশীর দেওয়ালে কিছু বৃদ্ধি। এগুলো বিভিন্ন আকারের হতে পারে এবং খুব ছোট বা বড় হতে পারে। কিছু মহিলার ফাইব্রয়েডের কোন অভিলক্ষণ দেখা যায় না। অন্য অনেক মহিলা আছে যাদের খুব বেশী রক্তপাত এবং স্বাভাবিকের থেকে লম্বা সময় ধরে হয়। ফাইব্রয়েড নিম্ন পেলভিক এলাকায় ব্যথার কারণ হতে পারে, যৌন সংযোগের সময় ব্যথার কারণ হতে পারে, সবসময় প্রস্রাবের তাগিদ হতে পারে, পায়খানার চাপ থাকতে পারে এবং কোষ্ঠবদ্ধতা হতে পারে। যেসব মহিলার ৩৫ বছরের উপর বা অনেকবার গর্ভাবস্থা হয়েছে, তাদের ফাইব্রয়েড হওয়ার ঝুঁকি বেশী।

পেলভিক প্রদাহজনকরোগ
পেলভিক প্রদাহজনক রোগ(বা পিআইডি)একটা সংক্রমণ যা মহিলাদের জনন অঙ্গের কিছু অংশে হয়। পিআইডি-র একটা লক্ষণ হল যোনিনালী থেকে দুর্গন্ধযুক্ত ক্ষরণ। এটার সাথে অনিয়মিত রজঃস্রাব বা যৌনক্রিয়ার সময় যন্ত্রণা হতে পারে। পিআইডি-র সবচেয়ে প্রচলিত কারণ হচ্ছে যৌন রোগের সংস্পর্শে আসা। পিআইডি একটা গুরুতর অসুস্থতা যা ফ্যালোপিয়ান টিউবের ক্ষতি করতে পারে এবং পরবর্তীকালে গর্ভধারণ রোধ করতে পারে।

প্রিমেনস্ট্রুয়ালসিনড্রোম
প্রিমেনস্ট্রুয়াল সিনড্রোম হচ্ছে কিছু লক্ষণের নাম যেগুলো রজঃস্রাবের ৭ থেকে ১৪ দিন আগে হতে পারে এবং কখনও কখনও স্রাব শুরু হওয়ার পরে কয়েকদিন থাকতে পারে। অনেক মহিলারাই বিভিন্ন মাত্রায় প্রিমেনস্ট্রুয়াল সিনড্রোম অনুভব করে। যাই হোক, কিছু মহিলার রজঃস্রাব কালের এই সময়ে তীব্র ব্যথা বা আবেগজনিত সমস্যা হতে পারে।

তাড়াতাড়ি রজঃস্রাবের সমস্যারনির্ণয়
রজঃস্রাবের সমস্যা নির্ণয়ের জন্য ডাক্তারদের বেশ কিছু পরীক্ষা করতে হতে পারে। তার মধ্যে অন্তর্গত হতে পারে পেলভিক পরীক্ষা, রক্ত পরীক্ষা এবং একটা আল্ট্রাসাউন্ড। রজঃস্রাবের সমস্যা যা একবারই হয়েছে বা অনেকদিন হয় নি, অনেক দিন পর্যন্ত অনির্ণীত থেকে যেতে পারে বা যতদিন না অনেক দিনের জন্য রজঃস্রাবের সমস্যা দেখা দেয়।

রজঃস্রাবের সমস্যার কিভাবে চিকিৎসা করা যায়
রজঃস্রাবের সমস্যার জন্য চিকিত্সা, সমস্যার ধরন এবং কতদিন ধরে সমস্যা চলছে তার উপর নির্ভর করে। সাধারণ সমস্যা বা ছয় মাসের কম সময়ের সমস্যার জন্য আপনার ডাক্তার জীবনধারার ধরন পরিবর্তন করার বা আত্ম-নির্ভরতা ব্যবস্থার নিরাময় নির্দেশ দিতে পারেন। এইসব নিরাময় ব্যবস্থার অন্তর্গত হতে পারেঃ
  • নিয়মিত ব্যায়াম;
  • সুষম খাদ্য গ্রহণ;
  • খাদ্যে আয়রন, ক্যালসিয়াম এবং ভিটামিন অন্তর্গত করা(বা বিকল্প গ্রহণ করা);
  • স্রাব যন্ত্রণার জন্য প্যারাসেটামল ট্যাবলেট গ্রহণ করা;
  • গরম জলের বোতল ব্যবহার করা.
আপনি রজঃস্রাব সমস্যার জন্য বিকল্প চিকিৎসার চেষ্টা করতে পারেন। তার মধ্যে অন্তর্গত হলঃ
  • স্রাবের সমস্যার জন্য বিশেষ করে উদ্ভাবিত কোন ভেষজ গ্রহণ করা;
  • রজঃস্রাবের সময় যন্ত্রণার জন্য ঔষধে ব্যবহৃত কোনো রকম সুগন্ধি গাছ বা তার শুকনো ফুল বা আদার চা গ্রহণ করা;
  • বন্য মিষ্ট আলু বা মাদারওয়র্ট ধরনের এ্যান্টিস্প্যাজ্‌মডিকস্ গ্রহণ করা;
  • পেটে ল্যাভেন্ডারের তেল মালিশ করা;
  • রাস্পবেরি পাতার চা গ্রহণ করা;
  • একটা জিংকগো বিকল্প নেওয়া;
  • বচ ফুলের ভেষজ ঔষধ,যা স্রাব সমস্যার জন্য বিশেষভাবে তৈরী;
  • মালিশ করানো;
  • রজঃস্রাবের অনিয়মিততার জন্য আকুপাংচার করানো
যদি খুব বেশী বা লম্বা সময়ের জন্য রজঃস্রাবজনিত সমস্যা থাকে তবে আপনার ডাক্তার সমস্যার চিকিত্সার জন্য অষুধের নির্দেশ দিতে পারেন। তার মধ্যে অন্তর্গত হতে পারে:
  • স্রাবকালীন যন্ত্রণার জন্য যন্ত্রণা নিরোধক অষুধ;
  • হরমোন বিকল্পন চিকিত্সা;
  • রজঃস্রাব নিয়মিত করতে গর্ভনিরোধকের ব্যবস্থা.
যদি কোন গুরুতর অসুস্থতা নির্ণীত হয়, যেমন ফাইব্রয়েড বা ক্যান্সার, তবে শল্য চিকিত্‌সার দরকার হতে পারে। অনেক রজঃস্রাব সমস্যা খুবই প্রচলিত এবং বেশী চিন্তার কারণ নয়। অনেক বিষয় ঋতুচক্রকে বিঘ্নিত করতে পারে এবং শীঘ্র ঋতুস্রাবের সমস্যাগুলি শরীরের ঋতুস্রাবের মানিয়ে নেওয়া চেষ্টার ফলে হতে পারে। যাইহোক, আপনার উচিত ডাক্তারের সাথে পরামর্শ করা, কোনরকম চিন্তা হলে, বিশেষ করে যদি আপনার অনেক লম্বা সময় ধরে স্রাব হয়, খুব বেশী রক্তপাত হয়, রক্ত জমে যায় বা অনেকদিন ধরে ঋতুস্রাবজনিত সমস্যা চলতে থাকে।